খেজুরের কথা ভাবলে আমাদের সবার চোখেই প্রায় একই দৃশ্য ভাসে—রমজানের ইফতার, বাটিতে রাখা কয়েকটি মিষ্টি ফল। আমরা জানি, খেজুর শক্তি দেয়, স্বাদেও দারুণ। কিন্তু এই পরিচিত ফলের আড়ালে এমন কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে, যা জানলে আপনার খেজুর খাওয়ার অভিজ্ঞতা এবং এর থেকে পাওয়া উপকার দুই-ই বেড়ে যাবে বহুগুণ।
চলুন, খেজুরের সেই সব গোপন রহস্য জেনে নেওয়া যাক, যা হয়তো আপনাকে আগে কেউ বলেনি।
১. ভিজিয়ে খাওয়া
ছোটবেলা থেকে আমরা অনেকেই দেখে এসেছি, খাওয়ার আগে খেজুর পানিতে বা দুধে ভিজিয়ে রাখা হয়। আমরা ভাবতাম, হয়তো শক্ত খেজুর নরম করার জন্যই এই ব্যবস্থা। কিন্তু এর পেছনের বিজ্ঞানটা আরও গভীর।
- টেনিন (Tannin) দূর হয়: খেজুরে টেনিন নামক একটি উপাদান থাকে, যা ফলের কষাভাবের জন্য দায়ী। পানিতে ভিজিয়ে রাখলে এই টেনিন অনেকটাই দূর হয়ে যায়। ফলে খেজুরের পুষ্টিগুণ শরীরে আরও সহজে শোষিত হয়।
- হজমে সহায়ক: ভেজানো খেজুর অনেক বেশি সহজপাচ্য। যাদের হজমের সমস্যা আছে, তাদের জন্য শুকনো খেজুরের চেয়ে ভেজানো খেজুর খাওয়া অনেক বেশি উপকারী।
কীভাবে করবেন: খাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট আগে কয়েকটি খেজুর পরিষ্কার পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। এই ভেজানো পানিটিও কিন্তু বেশ পুষ্টিকর, তাই ফেলে না দিয়ে পান করতে পারেন।
২. সাদা আস্তরণ
অনেক সময় খেজুরের গায়ে সাদা সাদা ছোপ দেখা যায়। এটা দেখেই অনেকে ভাবেন, খেজুর হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে বা ছত্রাক পড়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ধারণাটি ভুল।
- সুগার ব্লুম (Sugar Bloom): খেজুর যখন কিছুটা শুকিয়ে যায়, তখন এর ভেতরে থাকা প্রাকৃতিক চিনি বাইরে এসে ক্রিস্টাল বা স্ফটিকের মতো জমা হয়। একেই "সুগার ব্লুম" বলে। এটি দেখতে সাদা পাউডারের মতো এবং এটি খাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। এতে খেজুরের স্বাদ বরং আরও মিষ্টি অনুভূত হতে পারে।
- ছত্রাক (Mold): অপরদিকে, ছত্রাক দেখতে অনেকটা তুলতুলে, সবুজ, কালো বা ধূসর রঙের হয় এবং এর থেকে একটা বাসি, পচা গন্ধ আসে। এমন খেজুর অবশ্যই ফেলে দিতে হবে।
সহজ কথায়: সাদা ছোপ যদি হয় দানাদার বা পাউডারের মতো এবং কোনো বাজে গন্ধ না থাকে, তবে নির্ভয়ে খেতে পারেন। কিন্তু যদি তুলতুলে, আঁশযুক্ত এবং দুর্গন্ধযুক্ত মনে হয়, তবে সেটি ছত্রাক।
৩. সঠিক সঙ্গী নির্বাচন
একা খাওয়ার চেয়ে খেজুরের সঙ্গে যদি সঠিক খাবারটি জুড়ে দেওয়া যায়, তবে এর পুষ্টিগুণ কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
- বাদামের সাথে: খেজুরের প্রাকৃতিক চিনির সঙ্গে বাদামের (আমন্ড, আখরোট) স্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও প্রোটিন যুক্ত হলে তা একটি পারফেক্ট ব্যালান্সড স্ন্যাকস-এ পরিণত হয়। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে এবং দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখে।
- টক দইয়ের সাথে: খেজুরের মিষ্টি স্বাদের সঙ্গে টক দইয়ের প্রোবায়োটিকস মিশে হজমশক্তিকে আরও উন্নত করে। এটি অন্ত্রের জন্য দারুণ উপকারী একটি খাবার।
৪. শুধু মিষ্টি নয়, রান্নার এক দারুণ উপকরণ
খেজুরকে কি শুধু ফল হিসেবেই ভাবেন? তাহলে আপনি এর একটি বড় গুণ মিস করছেন। খেজুর হতে পারে আপনার রান্নাঘরের সেরা প্রাকৃতিক মিষ্টি।
- খেজুরের পেস্ট তৈরি: কয়েকটি বিচি ছাড়ানো খেজুর সামান্য গরম পানিতে ভিজিয়ে ব্লেন্ড করে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে স্বাস্থ্যকর 'ডেট পেস্ট'। এই পেস্ট আপনি চা, দুধ, পায়েস, কেক বা যেকোনো মিষ্টি খাবারে চিনির বদলে ব্যবহার করতে পারেন। এতে খাবারে বাড়তি পুষ্টিও যোগ হবে।
- নোনতা খাবারেও ব্যবহার: অবাক হচ্ছেন? মুরগির রোস্ট, মাটন কারি বা সালাদের ড্রেসিং-এ সামান্য খেজুরের পেস্ট ব্যবহার করলে খাবারের স্বাদে একটি নতুন মাত্রা যোগ হয়। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক বিখ্যাত পদে এভাবেই খেজুর ব্যবহার করা হয়।
৫. চাপানো খেজুর বনাম খোলা খেজুর: কোনটি কিনবেন?
বাজারে দুই ধরনের খেজুর পাওয়া যায়—এক ধরনের খেজুর মেশিনে চাপ দিয়ে প্যাকেটে ভরা হয় (Pressed Dates), আর অন্যগুলো খোলা অবস্থায় বিক্রি হয়। কেনার সময় এই পার্থক্যটা বোঝা জরুরি।
- চাপানো খেজুর (Pressed Dates): এগুলো সাধারণত মেশিনে প্রক্রিয়াজাত করা হয় এবং অনেক সময় কম দামি বা কিছুটা নিম্নমানের খেজুর একসাথে চাপ দিয়ে প্যাকেট করা হয়। এদের গায়ে অনেক সময় তেল বা গ্লুকোজ সিরাপ মাখানো থাকে চকচকে দেখানোর জন্য।
- খোলা বা লুজ খেজুর (Loose Dates): ভালো মানের খেজুর সাধারণত খোলা অবস্থায় বিক্রি হয়, যেখানে প্রতিটি ফল আলাদা থাকে। এতে আপনি প্রতিটি খেজুর দেখে, এর মান যাচাই করে কেনার সুযোগ পান। এগুলো সাধারণত বেশি প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর হয়।
শেষ কথা
খেজুর একটি সাধারণ ফল হতে পারে, কিন্তু এর সঠিক ব্যবহার ও কৌশল জানা থাকলে এটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে। পরেরবার যখন খেজুর কিনবেন বা খাবেন, এই বিষয়গুলো মাথায় রাখলে আপনি শুধু এর স্বাদই নন, এর আসল উপকারিতাও পুরোপুরি উপভোগ করতে পারবেন। 🌴